এখনকার মতো এতো উৎসব আয়োজন করে পহেলা বৈশাখ উদ্বযাপন আমাদের ছেলেবেলায় দেখিনি। বৈশাখ নিয়ে বড় করে উৎসব ঢাকার বাইরে তেমন করে হতোনা। মফস্বলে শহরগুলিতে বৈশাখের উৎসব শুরু হতো চৈত্র সংক্রান্তি দিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসতো বিশাল আয়োজনে। সেই মেলায় দেখেছি মানুষের পিঠে বিশাল আকারের বড়শি গেঁথে চড়কিতে ঘোরানো হতো। সেসব মানুষগুলো লাল রঙের কাপড় পড়া, চোখ রক্ত জবার মতো লাল, আর তাদের বড় ঝাকড়া চুল চুড়ো করে বাঁধা। তাতেও রক্ত জবা গোঁজা। অনেক সময় জীভেও বড়শি গেঁথে ঘূড়ানো হতো। সেসব বিভতস দৃশ্য এক পলকের বেশী দেখতে পারতাম না।
মেলা জুড়ে বিভিন্ন খাবার, দাবার, খেলনা, গৃহস্থালি জিনিস-পত্রের পশরা বসতো। লোহা, মাটি, কাঠের জিনিস-পত্র। থাকতো পাথরের থালা-বাটিও। একবার আম্মা ঐ মেলা থেকে কালো পাথরের দুটো কানা উঁচু থালা কিনে ছিলেন। আর কাঠের বারকোস। বড় বড় থালা, কিনারা উঁচু। ঐটাতে করেই আম্মাকে সবসময় আটা মাখতে দেখেছি। বেতের ছোট ছোট বাটির মতো চুপড়ি, আম্মা বলতেন কাঠা। ওগুলোতে আমরা মুড়ি খেতাম। মেলার প্রধান আকর্ষন ছিলো, তিলের তক্তি, গুড়, চিনি মাখানো ভ্যাটের খই, দুধ-সাদা কদমা, বাতাসা, হাওয়াই মিঠাই, খাজা। আর ছিলো পাখী। কত রকমের নানা বর্নের পাখী দেখা যেতো মেলায়। প্রতি বছর এক ঝাক মুনিয়া কিনে আনতাম। অতি যত্নের ফলে অল্প দিনেই তাদের ভবলীলা সাংগ হয়ে যেত। :| আর ছিলো নাগর-দোলা। ক্যাচর ক্যাচর শব্দে সেগুলো ধীরে ধীরে উপরে উঠে যেতো। ঐ ধীর গতিতে কোন আকর্ষন অনুভব করিনি বলেই হয়তো ওতে চড়া হয়নি। ছিলো বাঁশী। বাঁশীওয়ালা এতো মধুর সুরে বাঁশী বাঁজাতো। আজো সে সুর কানে বাঁজে। আমরাও কিনতাম বাঁশী। কিন্তু সুরের বদলে সেগুলো থেকে প্যা-পো ধ্বনীই বের হতো। সারা মেলা জুড়ে থাকতো ছোটদের সেই বাঁশীর প্যা-পো মধুর ধ্বনী। আহা! বড়রা তার মর্ম বুঝতোনা, তাই উদাস দুপুরে সে বাঁশীর সুরে কাঁচা-ঘুম ভেঙ্গে রক্তচক্ষু দেখিয়ে বাঁশীটি কেড়ে নিতেন। :| এমন অন্যায় না করলে আজ বাংলার ঘরে ঘরে পন্ডিতের ছড়া-ছড়ি থাকত। :)
আরেকটি প্রধান আকর্ষন ছিলো কখন শিব পার্বতী বের হবে। একটি ছেলে সারা শরীরে কালো বা নীল রঙ মেখে, মাথায় পাটের নকল চুঁড়ো বেধে শিব সাজে, আরেকটি ছেলে মেয়েদের মতো শাড়ী পরে, চোখে কাজল, মুখে একগাদা পাউডার মেখে সাদা ভুতের মত মুখ বানিয়ে পার্বতী সেজে ঘুঙ্গুর বাঁধা পায়ে ঝমঝমিয়ে তার দলবল নিয়ে হিন্দু-মুসলান প্রতিটি বাড়িতে যেয়ে উপস্থিত হতো। বাড়ীর মেয়েরা বিনা বাক্যে থালায় করে চাল, তরি-তরকারী, পয়সা তাদের ঝুলিতে ঢেলে দিতেন। তারা চলতো পরের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। আমরাও চলতাম পিছু পিছু।
পয়লা বৈশাখের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আম্মার যে কথাটি শুনতাম, তা হলো, “ দেখো, বচ্ছরকার পয়লা দিনেই এমন কিছু করোনা যাতে মার খাও”। এ বাক্য আমাদের দু’জনের উদ্দ্যেশ্যে ছোড়া হলেও বুঝতে মোটেই অসুবিধা হতোনা এটা আমাকেই বলা হচ্ছে। আমরা খুব সচেতন থাকতাম। কোন মতেই কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ বা মনমালিন্য যাতে না হয়। পয়লা বৈশাখে যা করবো, সারা বছর ধরেই তা আমাদের অনুসরন করবে। আম্মার শেখানো এ বাক্য এখনও মনে পড়ে। দুপুরে সবাই পরিপাটি হয়ে খেতে বসতাম। শুরু করতে হতো করলা ভাজা দিয়ে। আলু-ভর্তা, ডাল-ভর্তা, সজনে চচ্চড়ি, পাঁচ-মিশালি সবজি নিরামিষ, কই/ রুই মাছের দো-পেঁয়াজি আর কাঁচা আমের টক। বৈশাখে ইলিশ খেয়েছি বলে মনে পড়েনা। খাওয়ার পরে অবশ্যই থাকতো নলেন গুড়ের পায়েস। রাতে অবশ্য পোলাও কোর্মা হতো। এই ছিলো মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির পয়লা বৈশাখের ভোজ।
পয়লা বৈশাখে পান্তা খেয়েছি বলে মনে পড়েনা। যারা বলেন, “ পান্তা ইলিশ” বাঙ্গালির ঐতিহ্য। তাদের কাছে আমার প্রশ্নঃ ইলিশ ভাজার বিলাসিতাই যদি করা যায় তবে দু’মুঠো তপ্ত ভাতে নয় কেন? পান্তা ছিলো গরীব কৃষকের অসহায়, গরীবি অবস্থানের প্রতিক। রাতের খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া ভাতে পানি ঢেলে রাখা হতো। যেন গরমে ভাত নষ্ট না হয়। সূর্যদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে সে পান্তায় নুন, মরিচ দিয়ে কচলে ক্ষুধা নিবৃত্ব করে হাল নিয়ে ক্ষেতে যেত। গরম ইলিশ ভাজা, সপ্তপদের ভর্তার বিলাসিতা করবার সাধ্য বা সাধ কি তাদের ছিলো?
মফস্বল শহরের মিষ্টি ও সোনার দোকানগুলো আম্রপল্লব ও ফুল দিয়ে সাজিয়ে হালখাতা উদ্বযাপন হতো। পিতলের ঘটে সিঁদুর রাঙানো আম্রপল্লব শোভা পেতো। মুসলিম দোকানদাররা আম্রপল্লব বাদ দিলেও আপ্যায়ন বাদ দিতোনা। দোকানে যেই যেতো তাকেই মিষ্টি মুখ করানো হতো। বড় বড় দোকান থেকে অনেকের বাড়িতে মাটির হাড়িতে মিষ্টিও পাঠানো হতো। লাল শালু মোড়ানো লম্বা হিসাবের নতুন খাতা খোলা হতো।
পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে কাপড়-চোপড় কেনার কথাও মনে পড়েনা। তবে ঘরে থাকা সেরা কাপড়টিই সেদিন পড়তাম। বিকেলে আম্মা গা ধুয়ে পাটভাঙ্গা তাঁতের শাড়ি পড়তেন, বিনুনী করা লম্বা চুলকে খোপা করে নিতেন। তাতে গুঁজতেন রুপোর কাঁটা। খোপার একপাশে এক গোছা তাজা ফুল, কখনও বা কঁচি আমের পাতার গুচ্ছ। ছোট্ট কপালে লাল, কাল ছোট টিপ। কি যে সুন্দর লাগতো আম্মাকে দেখতে। তারপর আমাদের নিয়ে কোন আত্মিয়ের বাসায় কি পাড়ার কোন বাসায় বেড়াতে যেতেন। আমাদের বাসাতেও অথিতি আসতো। মিষ্টি আগেই কিনে রাখা হতো। মেহমানকে মিষ্টি, পায়েস, কাঁচা-আম পোড়া শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। মাটির সানকিতে কখনও খাইনি। আমাদের বাসায় তখন কাঁসার বাসনের চল ছিলো। জমসেদপুরী কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাসই আমরা ব্যাবহার করতাম। পরে অবশ্য মাঁজা-ঘষার অসুবিধার কারনে কাঁসার বাসন উঠিয়ে রাখতে হয়। তবে মেহমানের সামনে আমরা কাঁচের বাসনই বের করতাম। মাটির সানকি, ডাবর এসব আম্মা রান্না ঘরের কাজে ব্যাবহার করতেন। ডাবরে ভাতের মাড় ঢালতেন, তরি-তরকারি কুটে রাখতেন। হাড়ি-পাতিল ঢাকার জন্য মাটির সরা ব্যাবহার করতেন।
সুরঞ্জনা মায়া - নাগরিক সাংবাদিক বাংলাদেশ |
-------------------------------------------------------
বছর ঘুরে আবার এলো পহেলা বৈশাখ। বাংলা নতুন বছর। বাঙালির মনে এবার আনন্দ নেই। আতংকে ডুবে আছে পুরো পৃথিবী। নতুন বছরের প্রথম লগ্নে আমরা সিলেটবাসী ভূমিকম্পের আতংক নিয়ে দিনটি শুরু করেছি। তবুও আশা, প্রত্যাশা, প্রার্থনা করি আগামী দিন শুভ হোক। এই ভয়ংকর দিনের অবসান ঘটে আমরা পৃথিবীবাসী আবার স্বস্তির জীবন ফিরে পাবো। সবাই মানবিক হবো। প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব সুন্দর ভাবে টিকিয়ে রাখবো।
নাগরিক সাংবাদিক বাংলাদেশ Citizen Journalist Bangladesh
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। খুব শীঘ্রই আপনার উত্তর দেওয়া হবে।